বিশেষ প্রতিনিধি.নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরীরের পোস্টার লাগানো থামছেই না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারিকে ফাঁকি দিয়ে তারা রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার দেওয়ালে দেওয়ালে পোস্টার লাগিয়েছে। এবারে পোস্টারের ভাষা হয়েছে জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী-বিএনপিগোষ্ঠী কর্তৃক মার্কিন-ব্রিটেনের স্বার্থ রক্ষার প্রতিযোগিতায়’।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে পোস্টারগুলো সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। এ পর্যন্ত ধানমন্ডি, গ্রিনরোড, কলাবাগান, উত্তরা, সেগুনবাগিচা, মোহাম্মদপুর, রামপুরা, বনশ্রী, বাড্ডাসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় তাদের নতুন পোস্টার দেখা গেছে।
গত বুধবার বা বৃহস্পতিবার গভীর রাতে এই পোস্টারগুলো সাঁটানো হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। এমন এক সময় এ পোস্টারগুলো সাঁটানো হলো যখন বান্দরবানে গহিন পাহাড়ে র্যাব জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া নামের নতুন জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের গ্রেফতারে অভিযান চালাচ্ছে। এর আগে গত বুধবারও এ সংগঠনটির পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতার করে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)।
প্রকাশ্যে না থাকলেও কিছুদিন পর পর পোস্টার সাঁটিয়ে নিষিদ্ধ এ সংগঠনটি তাদের অস্তিত্বের জানান দেয় বলে জানিয়েছে র্যা ব কর্মকর্তারা। তারা বলেন, প্রকাশ্যে এ সংগঠনের কোনো ধরনের নাশকতা চালানোর শক্তি নেই। মাঝে মধ্যে গোপনে তারা কিছু পোস্টার সাঁটায়।
এ ব্যাপারে র্যা বের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, হিযবুত তাহরীরের নাশকতা চালানোর ক্ষমতা নেই। তাদের পোস্টার কারা ছাপাচ্ছে-এ ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। যেসব ছাপাখানায় বা ফটোস্ট্যাট মেশিনের দোকানে এসব পোস্টার ছাপানো এবং লিফলেট ফটোকপি করা হয়, তা ধরা পড়লে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের খিলগাঁও থানার ওসি ফারুকুল ইসলাম জানান, পোস্টার লাগানোর বিষয়টি তাদের নজরে এসেছে। বনশ্রীর ঐ এলাকাকে ঘিরে আমরা নজরদারি বাড়াব।
ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার ও কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট প্রধান মো. আসাদুজ্জামান বলেন, সম্প্রতি ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় হিযবুত তাহরীরের পোস্টার সাঁটানোর বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। আমরাও তদন্ত করছি, কারা এসব পোস্টার সাঁটিয়েছে এবং পোস্টারগুলো কোথায় থেকে ছাপানো হয়েছে। এ ব্যাপারে পোস্টার ছাপানোর ছাপাখানা শনাক্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
হিযবুত তাহরীর পৃথিবীর প্রায় ৪৩ দেশের মধ্যে বাংলাদেশসহ ১৮টি দেশে এ সংগঠনটি নিষিদ্ধ। দেশে হিযবুত তাহরীরের ১০টি পাঠচক্র রয়েছে। পাঠচক্রে পাকিস্তান, ফিলিস্তিন, ইরাক, আফগানিস্তানসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশের যুদ্ধ, মুসলমানদের ওপর নির্যাতনসহ বিভিন্ন বিষয়ের ভিডিও ফুটেজ, স্থির চিত্র ও বিভিন্ন পুস্তিকার মেধাবী শিক্ষার্থীদের অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। ছাত্র মুক্তির পাঠচক্রের নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মেধাবী ছাত্রদের মগজ ধোলাইয়ের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। হিযবুত তাহরীরের সদস্যদের প্রায় সবাই সমাজের শিক্ষিত, বিত্তশালী ও সরকারি পদস্থ কর্মকর্তাদের ঘরের সন্তান। জাতীয় নির্বাচনের আগে এরকম পোস্টার সাঁটানোর বিষয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করে জনমনে ভীতি সঞ্চার করার উদ্দেশ্যে নাশকতামূলক কার্যক্রমের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে বলে গোয়েন্দা সংস্থা মনে করছে।
সূত্র জানায়, ২০০০ সালে হিযবুত তাহরীর ‘লিবারেটেড ইয়ূথ’ নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গোপনে কার্যক্রম শুরু করে। এরপর ২০০৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে সংগঠনটি প্রকাশ্যে তৎপরতা চালায়। পরে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি এ জঙ্গি সংগঠনটি আত্মগোপনে যায়। আর ২০০৯ সালের ২০ মার্চ ছাত্র মুক্তির ব্যানারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বায়তুল মোকাররম এলাকায় পুনরায় বিক্ষোভ মিছিলের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করে। হিযবুত তাহরীরের কেন্দ্রীয় নেতারা ২০০৯ সালের ৩১ মার্চ অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে আয়োজিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে উপস্থিত হন। ঐ সম্মেলনে হিযবুত তাহরীরসহ সরকারবিরোধী সংগঠনগুলোর ওপর গ্রেফতার ও দমন পীড়নসহ বিভিন্ন নির্যাতনের ডকুমেন্টারি ফুটেজ এক প্রদর্শনীতে উপস্থাপনের চেষ্টা চালায়। ২০০৯ সালের অক্টোবরে মতিঝিলে তত্কালীন সংসদ সদস্য ও বর্তমানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নুর তাপসের ওপর বোমা হামলা হয়। তখন দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো হিযবুত তাহরীরকে সন্দেহের তালিকায় রাখে। পরে ২২ অক্টোবরে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে সংগঠনটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
সূত্র জানায়, নিষিদ্ধ এই সংগঠনের ১২ জন কেন্দ্রীয় নেতার মধ্যে মধ্যে প্রায় চার থেকে পাঁচ জন পুলিশ ও র্যা বের হাতে গ্রেফতার হন। এরপর কয়েক জন কেন্দ্রীয় নেতা ছদ্মবেশে তাদের তৎপরতা চালিয়ে আসছেন।
Leave a Reply