দুলাল মিত্র বলেন, ‘পদ্মা সেতু হয়ে ফ্যামিলি পোগ্রামে মাত্র তিন ঘণ্টায় পৌঁছে যাই বাগেরহাটে। কিন্তু ফেরার পথে মাত্র দুই ঘণ্টায় পদ্মা সেতুর কাছে এসে দুই কিলোমিটার লম্বা লাইন দিয়ে দুই ঘণ্টা লেগে যায় টোল দিতে। এরপর বঙ্গবন্ধু মহাসড়কের টোল দিতে এক ঘণ্টা আর মো. হানিফ ফ্লাইওভারের জ্যামে রাত ১টা বেজে যায় শান্তিনগরের বাসায় ফিরতে।’ তিনি পদ্মা সেতুর টোলপ্লাজার অবস্থাপনায় প্রতিদিন দুই থেকে পাঁচ কিলোমিটার যানজটের অভিযোগ করেন। আর ভোগান্তির শিকার হন যাত্রীরা।
তিনি আরো বলেন, সেতুর প্রতিটি বুথে ধীরগতিতে টেল আদায়ের কারণে এক থেকে দেড় ঘণ্টা যানবাহনের দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষা করতে হয়। এছাড়া সেতুর টেলের লেন চেট করে তৈরির কারণে যানবাহন চলাচলের সময় টেল বুথে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে বাসের লুকিং গ্লাস ভেঙে যায়।
শুধু দুলাল মিত্রই নন, তার মতো বরিশাল শহরের স্থায়ী বাসিন্দা আমিনুল ইসলামও এই অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, ভাবছিলাম পদ্মা সেতু দিয়ে অনেক কম সময়ে ঢাকায় আসতে পারব। কিন্তু সেতুর টোলপ্লাজার জ্যামের কারণে এক ঘণ্টার বেশি সময় চলে যায়। গত ১৫ জুলাই বিকাল সাড়ে ৫টায় বরিশালের গৌরনদী বাসস্টপেজে গাড়িতে উঠি। গৌরনদী থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত দুই লেনের সড়ক অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। তাই গাড়ি কম গতিতে চলছে। ভাঙ্গা পর্যন্ত আসতে সন্ধ্যা ৭টা পার হয়ে যায়। তারপর আধা ঘণ্টার মধ্যে পদ্মা সেতুতে চলে আসি। কিন্তু টোলপ্লাজায় প্রায় এক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। শেষ পর্যন্ত গুলিস্তানে আসতে রাত ১০টা বেজে যায়। টোলপ্লাজায় যানজট না থাকলে আরো এক ঘণ্টা আগে ঢাকায় পৌঁছানো যেত।
এদিকে সেতু কর্তৃপক্ষ জানায়, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর বাস ও ট্রাকের আঘাতে এ পর্যন্ত দুই প্রান্তের পাঁচ-ছয়টি টোল বুথ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে সোয়া ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ সেতুতে মাত্র ১২টি টোলবুথ পর্যাপ্ত নয় বলে সেতু বিভাগের বিশেষজ্ঞরা অভিমত প্রকাশ করেন। তারা দেড় থেকে দুই ঘণ্টা যানজট দূর করতে হলে টোলপ্লাজা ডিজিটাল করার পরামর্শ দেন।
শরীয়তপুরের ইলিশ পরিবহনের চালক মো. সালাম হোসেন বলেন, এত বড় সেতুতে মাত্র ছয়টি টোল বুথ। গাড়ির চাপ আরো বাড়লে এই যানজট ১০ কিলোমিটার ছাড়িয়ে যাবে। সেতুর টোলের রাস্তা এত ছোট যে, খুব ধীরে গাড়ি চালাতে হয়। এতে পেছনে যানজটের সৃষ্টি হয়।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ও গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. মো. সামছুল হক বলেন, পদ্মা সেতুর টোল প্লাজায় অব্যবস্থাপনা লক্ষ করা যাচ্ছে। এই অব্যবস্থাপনার কারণে টোল আদায় করতে সময় লেগে যায়। এতে সেতুর দুই পারে সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। এত বড় অবকাঠামো নির্মাণ করা হলেও পরিকল্পনা ও সমন্বয়হীনতার কারণে টোলপ্লাজায় এই সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। বিশ্বের কোথাও এখন আর ম্যানুয়াল টোল আদায় করা হয় না। বড় বড় মহাসড়ক ও সেতুতে সবখানে এখন ডিজিটালি টোল আদায় করা হয়। পদ্মা সেতুতেও তাই করতে হবে। তা না হলে এই সমস্যা থেকেই যাবে। এ ছাড়া একই মহাসড়কে পরপর তিন-চার বার টোল আদায়ের কারণে যানবাহনের গতি অনেকটা ধীর হয়ে যায়। দ্রুত এই সমস্যা দূর করার জন্য টোলপ্লাজাগুলো ডিজিটাল করার পরামর্শ দেন তিনি।
তবে সেতু বিভাগের সচিব মো. মনজুর হোসেন টোল আদায়ে অব্যবস্থাপনার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ১৫ জুলাই পদ্মা সেতুর জাজিরা টোলপ্লাজা পরিদর্শন করেছি। ঈদে যানবাহনের চাপে কিছু যানজট তৈরি হয়েছে। কিন্তু টোল আদায়ে কোনো ধীরগতি ছিল না।
পদ্মা সেতুর টোল আদায়কারী ও সেতুর রক্ষণাবেক্ষণে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে কোরিয়া এক্সপ্রেস করপোরেশন (কেইসি) ও চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি)। আগামী পাঁচ বছরের জন্য এ দুটি প্রতিষ্ঠান টোল আদায়, সেতু ও সেতুর দুই প্রান্তে যানবাহন চলাচল ব্যবস্থাপনায় আধুনিক পদ্ধতি চালু এবং সেতু ও নদীশাসনের কাজ রক্ষণাবেক্ষণ করবে। এর জন্য পাঁচ বছরে তাদের দিতে হবে ৬৯৩ কোটি টাকা।
Leave a Reply